ধর্ষনঃ কারন, করনীয় এবং শাস্তি
ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা নিয়ে আমাদের সমাজের বদ্ধমূল ধারণা হলো—এটি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জন্য সম্মানহানিকর। ফলে অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। প্রচলিত আইনে এ ধরনের প্রমাণিত অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সমাজের আনাচকানাচে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সব সময়। শিশু, যুবা, বৃদ্ধা কেউ বাদ যাচ্ছে না। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদে থাকার দায়িত্ব প্রথমত ব্যক্তির নিজের। যৌন সহিংসতা, এর নেতিবাচক প্রভাব, শাস্তি এবং করণীয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং সচেতনতা প্রাক-কৈশোর ছেলেমেয়েদের থাকা জরুরি, কারণ সচেতনতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। এছাড়াও আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় নারী নির্যাতনসহ অনেক অপরাধেরই বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা জটিলতা রয়েছে। শাস্তি নিশ্চিত করতে অনেক সময় চলে যায়। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে দেশের প্রচলিত কঠোর আইনকে আরও কঠোর ও শক্তিশালী করতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে ধর্ষণে উদ্ধত হওয়ার আগে একজন ব্যক্তির মাথায় শাস্তির বিষয়টি আসে। ধর্ষনের অন্যতম কারনঃ ধর্ষনের অন্যতম কারন হচ্ছে গ্রাম্য সালিসি। রিমোট এলাকায় শিশু ও নারী ধর্ষনের অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়।অধিকাংশ অপরাধীদের হিস্ট্রি জেনে জানা যায় পূর্বেও তারা এরকম একাধিক অপরাধ সংঘটিত করছে। স্থানীয় লোকজন সালিসি মিমাংসা করে এরকম জঘন্য অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। রিমোট এলাকায় এধরনের অপরাধের বিচার করা হয় কিছু টাকা জরিমানা এবং অপরাধীকে জুতাপেটা করার মাধ্যমে। ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে সরকারকে গ্রাম্য সালিসির বিরুদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।যেনো কোন চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলর, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এধরণের অপরাধের বিচার করার সাহস না দেখায়। নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানঃ দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা বুঝতে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায়। পুলিশ পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে—২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছে। তাদের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৬৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় মামলা করেছে। ২০২০ সালে সেটি আরও বেড়ে যায়। সে বছর ২২ হাজার ৫১৭ জন ভুক্তভোগী মামলা করে। এভাবে ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬ জন, ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬ জন, ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১ জন এবং ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৫৭১ জন মামলা করে। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০ জন মামলা করেছেন। এই প্রতিবেদনগুলো নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। নিশ্চিত থাকুন, পুরো পরিসংখ্যান এখানেও নেই। এতেই চিত্রটা ভয়াবহ লাগছে। প্রকৃত পরিসংখ্যানটা সামনে আসলে কেমন লাগবে একবার ভাবুন। ধর্ষনের শিকার নারীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থাঃ লন্ডনভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীরা হৃদ্রোগ, আন্ত্রিক ও যৌন রোগ, মাথা ও মেরুদণ্ডে ব্যথা, গর্ভধারণে জটিলতা, গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চরম বিষণ্নতার মতো নানা রোগে ভোগেন। বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে এমন সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির মতে, নারীরা মাথা, মুখ, ঘাড়, বুক এবং তলপেটে আঘাত নিয়ে তাদের কাছে আসে। তাদের ভেতরে প্রচণ্ড ভীতি ও হতাশাবোধ কাজ করে। প্রচলিত আইনে ধর্ষনের সংজ্ঞাঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয় তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাতেই ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা। এরপরই রয়েছে, নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা। তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয় তবে তার সম্মতি নেয়া হোক বা না নেয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসঙ্গত স্বামী ভেবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন, এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তার স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে প্রচলিত আইনে ধর্ষনের শাস্তির পরিমাণঃ বাংলাদেশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যুদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বা ২০০০ সনের ৮ নং আইন। এই আইনের ৯-এর (১) নং ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করা হয় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না হলে ধর্ষণের ভয়াবহতা কখনোই থামবে না। এটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে, নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবে তেমনই নারীকে নির্যাতন ও নিপীড়নে আরও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকবে। লেখকঃ মিরাজুল ইসলাম শিক্ষানবিশ আইনজীবী

ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা নিয়ে আমাদের সমাজের বদ্ধমূল ধারণা হলো—এটি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জন্য সম্মানহানিকর। ফলে অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। প্রচলিত আইনে এ ধরনের প্রমাণিত অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সমাজের আনাচকানাচে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সব সময়। শিশু, যুবা, বৃদ্ধা কেউ বাদ যাচ্ছে না।
যে কোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদে থাকার দায়িত্ব প্রথমত ব্যক্তির নিজের। যৌন সহিংসতা, এর নেতিবাচক প্রভাব, শাস্তি এবং করণীয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং সচেতনতা প্রাক-কৈশোর ছেলেমেয়েদের থাকা জরুরি, কারণ সচেতনতা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে। এছাড়াও আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় নারী নির্যাতনসহ অনেক অপরাধেরই বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা জটিলতা রয়েছে। শাস্তি নিশ্চিত করতে অনেক সময় চলে যায়। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে দেশের প্রচলিত কঠোর আইনকে আরও কঠোর ও শক্তিশালী করতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে ধর্ষণে উদ্ধত হওয়ার আগে একজন ব্যক্তির মাথায় শাস্তির বিষয়টি আসে।
ধর্ষনের অন্যতম কারনঃ ধর্ষনের অন্যতম কারন হচ্ছে গ্রাম্য সালিসি। রিমোট এলাকায় শিশু ও নারী ধর্ষনের অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়।অধিকাংশ অপরাধীদের হিস্ট্রি জেনে জানা যায় পূর্বেও তারা এরকম একাধিক অপরাধ সংঘটিত করছে। স্থানীয় লোকজন সালিসি মিমাংসা করে এরকম জঘন্য অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। রিমোট এলাকায় এধরনের অপরাধের বিচার করা হয় কিছু টাকা জরিমানা এবং অপরাধীকে জুতাপেটা করার মাধ্যমে। ধর্ষনের মত জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে সরকারকে গ্রাম্য সালিসির বিরুদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।যেনো কোন চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলর, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এধরণের অপরাধের বিচার করার সাহস না দেখায়।
নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যানঃ
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা বুঝতে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায়। পুলিশ পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে—২০১৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করেছে। তাদের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৬৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় মামলা করেছে। ২০২০ সালে সেটি আরও বেড়ে যায়। সে বছর ২২ হাজার ৫১৭ জন ভুক্তভোগী মামলা করে। এভাবে ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬ জন, ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬ জন, ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১ জন এবং ২০২৪ সালে ১৭ হাজার ৫৭১ জন মামলা করে। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৪০ জন মামলা করেছেন। এই প্রতিবেদনগুলো নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। নিশ্চিত থাকুন, পুরো পরিসংখ্যান এখানেও নেই। এতেই চিত্রটা ভয়াবহ লাগছে। প্রকৃত পরিসংখ্যানটা সামনে আসলে কেমন লাগবে একবার ভাবুন।
ধর্ষনের শিকার নারীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থাঃ
লন্ডনভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, নির্যাতনের শিকার নারীরা হৃদ্রোগ, আন্ত্রিক ও যৌন রোগ, মাথা ও মেরুদণ্ডে ব্যথা, গর্ভধারণে জটিলতা, গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চরম বিষণ্নতার মতো নানা রোগে ভোগেন। বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে এমন সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির মতে, নারীরা মাথা, মুখ, ঘাড়, বুক এবং তলপেটে আঘাত নিয়ে তাদের কাছে আসে। তাদের ভেতরে প্রচণ্ড ভীতি ও হতাশাবোধ কাজ করে।
প্রচলিত আইনে ধর্ষনের সংজ্ঞাঃ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয় তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী।
দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাতেই ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা।
এরপরই রয়েছে, নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা।
তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয় তবে তার সম্মতি নেয়া হোক বা না নেয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসঙ্গত স্বামী ভেবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন, এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তার স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে
প্রচলিত আইনে ধর্ষনের শাস্তির পরিমাণঃ
বাংলাদেশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় কারও অপরাধ প্রমাণিত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা মৃত্যুদণ্ড।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বা ২০০০ সনের ৮ নং আইন।
এই আইনের ৯-এর (১) নং ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করা হয়
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না হলে ধর্ষণের ভয়াবহতা কখনোই থামবে না। এটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে, নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হবে তেমনই নারীকে নির্যাতন ও নিপীড়নে আরও নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকবে।
লেখকঃ মিরাজুল ইসলাম
শিক্ষানবিশ আইনজীবী