গাজায় ‘গণহত্যা’ মুসলিম বিশ্ব কি শুধু উদ্বেগই প্রকাশ করে যাবে?

গাজায় ‘গণহত্যা’ মুসলিম বিশ্ব কি শুধু উদ্বেগই প্রকাশ করে যাবে?

গাজায় দিনের পর দিন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার ইসরাইল। এ নিয়ে পশ্চিমারা যেমন চুপ, তেমনি মুখে কুলুপ মুসলিম বিশ্বেরও। কিছুদিন পর পর কেবল উদ্বেগ প্রকাশেই যেন দায়িত্ব শেষ সবার। গাজা ইস্যুতে ক্ষমতাধরদের আচরণ দেখলে মনে হতেই পারে, উপত্যকাটি হয়তো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন।

গাজার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা একজন ফিলিস্তিনি মার্কিন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাদিদ, যিনি ১৯৪৮ সালে নাজারেথে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইসরাইলি দখলদারিত্বের কারণে শরণার্থী হয়েছিলেন। গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইল নতুন করে আগ্রাসন শুরু করার পর আরব ও মুসলিম দেশগুলোর তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি।

বুধবার (১৯ মার্চ) এক ভিডিওতে হাদিদ প্রশ্ন রাখেন, ‘যা ঘটছে তা আমার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে। আপনাদের প্রভাব কাজে লাগান। সমগ্র ইউরোপ, সমগ্র আমেরিকা, সমগ্র আরব বিশ্ব, সমগ্র ইসলামী বিশ্বে আপনাদের অসাধারণ প্রভাব রয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন মারা যাওয়া এই ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করার জন্য আপনারা আজ কোথায়?’

আপনারা কীভাবে এসব মেনে নিতে পারেন এবং এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন?’, প্রশ্ন করেন হাদিদ।

গত ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি এবং মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো দীর্ঘদিন পর বোমা হামলার ভয় ছাড়াই প্রতিদিনের রোজা শেষ করে আনন্দ নিয়ে ইফতারের আয়োজন করে আসছিল।

কিন্তু, গেল মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) ভোরে ইসরাইল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর বোমাবর্ষণ করে আবারও সৃষ্টি করে নারকীয় এক পরিস্থিতি।

বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবু এবং ইতোমধ্যেই বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে চার শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ’ মানুষ। এর মধ্য দিয়ে পুনরায় শুরু হয়েছে ইসরাইলের গণহত্যা।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইল ৬২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং আরও ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষকে আহত করেছে। পাশাপাশি লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করেছে তেল আবিব, যা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের উদ্ধৃত বিপজ্জনক পরিকল্পনার অংশ।

ফিলিস্তিনি মার্কিন ব্যবসায়ী হাদিদ বলেন,

এই মানুষগুলো (গাজার) মারা যাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। তারা ক্ষুধার্ত। এসব না জেনে আপনারা রাতের খাবার খেতে পারেন না। তারা আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করছে। কোন কারণে? আপনাদের সাহস কীভাবে হলো?

তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা সবাই, সারা বিশ্বের সকল মুসলিম সম্প্রদায়, আরব বিশ্বের সকল মুসলিম সম্প্রদায়; আপনাদের সাহস কীভাবে হলো? আপনারা কোথায়? কারও সঙ্গে কথা না বলে (ইসরাইলকে থামাতে) কীভাবে থাকতে পারেন আপনারা?’

ইসরাইল কোনো ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়’ উল্লেখ করে হাদিদ বলেন, ‘এটা হলো ইহুদিবাদ। এরা অপরাধী। অপরাধীরা, তাদের নেতারা সবাই জেলে যাচ্ছে এবং তাদেরও (ইসরাইলি সেনাদের) জেলে যাওয়া উচিত। আমি অনেক আইডিএফ (ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) সেনার কথা শুনি। তারা যা করেছে তা ভয়াবহ।’

হাদিদ এর আগে, অবরুদ্ধ ছিটমহলের ভেতরে গাজা থেকে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের দেশত্যাগের তুলনা করেছেন ৭৫ বছর আগে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের সময় তার মায়ের অভিজ্ঞতার সাথে, যখন ইহুদিবাদী মিলিশিয়ারা সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক তাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দিয়েছিল।

হাদিদ আনোয়ার মোহাম্মদ হাদিদ এবং খাইরিয়া দাহেরের সন্তান। নাকবার সময়, হাদিদ পরিবার প্রথমে লেবানন এবং তারপর সিরিয়ায় পালিয়ে যায়।

২০১৫ সালে হাদিদ বলেছিলেন,

আমরা সিরিয়ায় শরণার্থী হয়েছিলাম এবং সাফাদে (এখন উত্তর ইসরাইলে) আমাদের বাড়ি হারিয়েছিলাম একটি ইহুদি পরিবারের কাছে। ওই পরিবারকে আমরা আশ্রয় দিয়েছিলাম যখন তারা পোল্যান্ড থেকে আসা শরণার্থী ছিল এবং কেউ তাদের গ্রহণ করছিল… তারা দুই বছর ধরে আমাদের অতিথি ছিল। কিন্তু এরপর নিজেদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আমাদেরই শরণার্থী করে তারা।

আনাদোলু এজেন্সিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টি তুলে ধরে হাদিদ স্মরণ করেন, তার মা বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা এখন শরণার্থী। তাই তিনি ঘর থেকে একটি কম্বল নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন যাতে তার বাচ্চাদের রাস্তায় ঠান্ডা না লাগে।

হত্যাযজ্ঞ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মোহাম্মদ হাদিদ তার সবশেষ ভিডিওতে বলেছেন,

ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের উচিত ফিলিস্তিনে আমার পরিবার এবং আমার জনগণকে হত্যা বন্ধ করা। আরব বিশ্ব কিছু করো। ইউরোপীয়রা, কিছু করো। এই নিপীড়ন, এই দখলদারিত্ব, এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, কাতার ও মিশরসহ কয়েকটি দেশ গাজায় যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চালালেও তা কার্যত ব্যর্থই হয়েছে। অনেকে মনে করেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য না থাকাই এর মূল কারণ। তারা এক হলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সরাসরি সমর্থন দেয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতো এবং গাজায় এমন তাণ্ডব চালানোরও সাহস পেতো না তেল আবিব।

অপরদিকে, সন্ত্রাসবাদ আর মানবতার সবক দেয়া পশ্চিমারা গাজা ইস্যুতে যেন ‘অন্ধের ভূমিকা’ পালন করছে। ইসরাইলকে থামানোর চেষ্টা তো ভালো, উল্টো তাদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ।

সবমিলিয়ে, ইসরাইলকে থামাতে এবং গাজাবাসীকে বাঁচাতে হলে মুসলিম বিশ্বের এক হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন অনেকে।

সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড